Showing posts with label প্রকৃতির কবিতা. Show all posts
Showing posts with label প্রকৃতির কবিতা. Show all posts

ফাল্গুন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ফাল্গুনে বিকশিত
      কাঞ্চন ফুল,
ডালে ডালে পুঞ্জিত
      আম্রমুকুল।
চঞ্চল মৌমাছি
      গুঞ্জরি গায়,
বেণুবনে মর্মরে
      দক্ষিণবায়।
 
      স্পন্দিত নদীজল
           ঝিলিমিলি করে,
      জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি
           বালুকার চরে।
      নৌকা ডাঙায় বাঁধা,
           কাণ্ডারী জাগে,
      পূর্ণিমারাত্রির
           মত্ততা লাগে।
 
খেয়াঘাটে ওঠে গান
      অশ্বত্থতলে,
পান্থ বাজায়ে বাঁশি
      আনমনে চলে
ধায় সে বংশীরব
      বহুদূর গাঁয়,
জনহীন প্রান্তর
      পার হয়ে যায়
 
      দূরে কোন্শয্যায়
           একা কোন্ছেলে
      বংশীর ধ্বনি শুনে
       ভাবে চোখ মেলে
যেন কোন্ যাত্রী সে,
       রাত্রি অগাধ,
জ্যোৎস্নাসমুদ্রের
      তরী যেন চাঁদ।
 
      চলে যায় চাঁদে ' ড়ে
           সারা রাত ধরি,
      মেঘেদের ঘাটে ঘাটে
           ছুঁয়ে যায় তরী।
      রাত কাটে, ভোর হয়,
           পাখি জাগে বনে
      চাঁদের তরণী ঠেকে
           ধরণীর কোণে।

বঙ্গভাষা - মাইকেল মধুসূদন দত্ত

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;--
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;--
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে, --
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।"
পালিলাম আজ্ঞা সুখে' পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে‍‍‍‍‍‍‍‍‍‌‌‌।।



কপোতাক্ষ নদ - মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।

হেমন্ত - সুফিয়া কামাল

সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?

আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।

হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।

তাহারেই পড়ে মনে - সুফিয়া কামাল

“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”

ফুল ফুটুক না ফুটুক - সুভাষ মুখোপাধ্যায়


ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

কাশফুলের কাব্য - নির্মলেন্দু গুণ


ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন ফুটবে তোমায় দেখব,
তোমার পুষ্প বনের গাঁথা মনের মত লেখব।

তখন কালো কাজল মেঘ তো ব্যস্ত ছিল ছুটতে,
ভেবেছিলাম আরো 'দিন যাবে তোমার ফুটতে।

এক গাঁয়ে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
            সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
            তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া
            চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
            কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে।

                  আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
                  আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
                  আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
                  আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

আমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
                          চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
                      আমি চোখ মেললুম আকাশে,
                          জ্বলে উঠল আলো
                               পুবে পশ্চিমে।
                   গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম "সুন্দর',
                               সুন্দর হল সে।
                      তুমি বলবে, যে তত্ত্বকথা,
                                   কবির বাণী নয়।
                          আমি বলব, সত্য,
                                  তাই কাব্য।
                         আমার অহংকার,
                             অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
                        মানুষের অহংকার-পটেই
                              বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।
                   তত্ত্বজ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে,
                                    না, না, না--
                   না-পান্না, না-চুনি, না-আলো, না-গোলাপ,
                                     না-আমি, না-তুমি।
                   দিকে, অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা
                                    মানুষের সীমানায়,
                             তাকেই বলে "আমি'
সেই আমির গহনে আলো-আঁধারের ঘটল সংগম,
                               দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস।
                          "না' কখন ফুটে উঠে হল "হাঁ' মায়ার মন্ত্রে,
                                  রেখায় রঙে সুখে দুঃখে।
                        একে বোলো না তত্ত্ব;
                          আমার মন হয়েছে পুলকিত
                               বিশ্ব-আমির রচনার আসরে
                                    হাতে নিয়ে তুলি, পাত্রে নিয়ে রঙ।
                                  পণ্ডিত বলছেন--
                             বুড়ো চন্দ্রটা, নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার,
                          মৃত্যুদূতের মতো গুঁড়ি মেরে আসছে সে
                                                পৃথিবীর পাঁজরের কাছে।
                                    একদিন দেবে চরম টান তার সাগরে পর্বতে;
                                      মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায়
                                         পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য,
                                      গিলে ফেলবে দিনরাতের জমাখরচ;
                                         মানুষের কীর্তি হারাবে অমরতার ভান,
                                               তার ইতিহাসে লেপে দেবে
                                                  অনন্ত রাত্রির কালি।
                             মানুষের যাবার দিনের চোখ
                                  বিশ্ব থেকে নিকিয়ে নেবে রঙ,
                               মানুষের যাবার দিনের মন
                                         ছানিয়ে নেবে রস!
                             শক্তির কম্পন চলবে আকাশে আকাশে,
                                  জ্বলবে না কোথাও আলো।
                               বীণাহীন সভায় যন্ত্রীর আঙুল নাচবে,
                                         বাজবে না সুর।
                               সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে
নীলিমাহীন আকাশে
                             ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে।
                                  তখন বিরাট বিশ্বভুবনে
                             দূরে দূরান্তে অনন্ত অসংখ্য লোকে লোকান্তরে
                               বাণী ধ্বনিত হবে না কোনোখানেই--
                                      "তুমি সুন্দর',
                                    "আমি ভালোবাসি'
                          বিধাতা কি আবার বসবেন সাধনা করতে
                                    যুগযুগান্তর 'রে।
                               প্রলয়সন্ধ্যায় জপ করবেন--
                                           "কথা কও, কথা কও',
                               বলবেন "বলো, তুমি সুন্দর',
                                    বলবেন "বলো, আমি ভালোবাসি'?


_