বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা | শামসুর রাহমান


নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলি শৈশবেপাখি সব করে রবলে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যেহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
          
অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, যেখানে কুসুম কলি সবই
          
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে।

আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ য়ে ভেড়ে
               
আমারই বন্দরে।

গলিত কাঁচের মতো জলে ফাৎনা দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ রে গেছে বেলা। মনে পড়ে, কাঁচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমিহাসি-খুশি খেয়া বেয়ে
           
পৌঁছে গেছি রতœদ্বীপে কম্পাস বিহনে।

তুমি আসো, আমার ঘুমের বাগানেও
           
সে কোন্ বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
           
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফ্ল্লু মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
           
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বারবার কিংবা টুকটুকে লঙ্কা-ঠোঁট টিয়ে য়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।

আমার অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
          
যুদ্ধের আগুনে,
          
মারীর তান্ডবে
          
প্রবল বর্ষায়
          
কি অনাবৃষ্টিতে,
          
বারবনিতার
          
নূপুর-নিক্বনে,
          
বনিতার শান্ত
          
বাহুর বন্ধনে
          
ঘৃণায় ধিক্কারে
          
নৈরাজ্যের এলো-
          
ধাবাড়ি চিৎকারে
          
সৃষ্টির ফাল্গুনে
হে আমার আঁখি তারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শোবায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
           
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন লে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
_