মানুষ একটি অসমাপ্ত কবিতা - মোহাম্মদ হোসাইন

বোবা কে পড়া যায়- সে বোবা 
গাছ কে পড়া যায়- সে গাছ 
কিন্তু, একজন মানুষকে পড়া যায় না - মানুষ
একটি বই পড়তে যেমন তার ভেতরে ঢুকতে হয়, 
তেমনি একজন মানুষকে জানতেও তার ভেতরটা পড়ে নিতে হয়...
মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে আমি কতো কতো মানুষ পড়ি, 
কতো কতো অনাহুত পৃষ্ঠা ওল্টাই-দেখি চারপাশে অজস্র মৃত মানুষ, 
অজস্র মুখোশের মানুষ বিকলাঙ্গের বেশে ঘুরে বেড়ায়...
আমি আসলে আমাকেই পড়ি 
পথের যেমন শেষ নেই তেমনি জীবনেরও-মানুষেরও 
কেননা, এক জীবন শেষ হতে না হতে হতে 
অন্য আরেক জীবন শুরু হয়ে যায়...
মূলত মানুষ একটি অসমাপ্ত কবিতারই নাম.... 

আসল রাজা । অরুণ সরকার

 

‘কাকের মুখে রটলো খবর বনের রাজা বাঘ মরেছে।

জন্তুরা সব একে একে মরা বাঘটা এলো দেখে।

কেউ করলো আহা উহু। কেউ ভাবলো বাঁচা গেলো।

কদিন পর বললো সবাই, বাঘ মরেছে এখন তবে

বনের একটা রাজা তো চাই, কে তাহলে রাজা হবে!

শেয়াল শুনে চুপি চুপি, মাথায় দিয়ে গাধার টুপি

লাফিয়ে উঠে সিংহাসনে, ডাকলো হুয়া হুক্কা রবে,

বললো- সেই রাজা হবে!

ভালুক বললো, এই বেয়াদব। ওখান থেকে নাম এখুনি,

রাজা হবো এই কথাটি ফের যদি তোর মুখে শুনি

একটি চড়ে অক্কা পাবি। হুক্কা-হুয়া ভুলে যাবি!

বাঘ নেই তো আমি আছি, বাঘের পরেই আমার দাবি!

নেকড়ে বলে, ভালোই আছো, করবে তুমি ভালুক নাচও

সিংহাসনে বসে আবার ভাবছো বুঝি রাজাও হবে

আমি হলাম বাঘের পিসে, আমার দাবি কমটা কিসে

আমায় রাজা করতে হবে!

হায়েনা বললো, হাসাস না আর, পিসি কোথায় ঠিক নেই তার

এলেন উনি পিসে মশাই, আমরা কোথায় যাইরে তবে,

আমায় রাজা করতে হবে।

বাঁদর বললো, ওরে হায়না জুড়ে দিলি তুইও বায়না

জানিস তো কেউ তোকে চায় না, ভাগাড় দিয়ে লেংচে চলিস

রাজা হবো তুইও বলিস! আমি বানর অর্ধেক নর, বনবাসী,

বুদ্ধিজীবী, আমায় রাজা করতে হবে সব্বাইকে বলে দিবি!’

ভাষা - বিপ্লব সাইফুল

 

মানুষ একদিন মরে যায়

মানুষকে একদিন মরে যেতেই হয়

যা বলতে চেয়েছিলাম কবিতার নামে

যা বলতে চেয়েছিলাম গল্পের ছলে

তা বলতে পারলাম কই!

হয়তো একদিন কাচপোকা, ঝিঁঝি পোকা হয়ে

পৃথিবীর অন্ধকারে বলে যাবো সেইসব

মানুষের মিছিলে একলা থাকার যতো গান

যতো বিরহ, দুঃখের আড়াল

বলে যাবো, বলে যাবো

তখনো মানুষের কাছে অচেনাই থেকে যাবে

সেইসব বলা কথা

মানুষের কাছে থেকে গেলো যেমন

এই মানুষ জন্মের ভাষা!

দাঁড়াও – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও |

তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও |

এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও |

দেহ-৯ । আহমেদ শিপলু

 

তোমার দিকে ধেয়ে এলো নদী

তোমার দিকে ছুটে এলো সড়ক

তোমার দিকে নেমে এলো চাঁদ

তবু তুমি গুটিয়ে যেতে থাকলে নিজের দিকে!


একটা বিষণ্ণ সাপের সাথে খেলছিলো ঝগড়াটে রোদ

একটা রাগি বেজির সাথে হাসছিলো বৃষ্টির জল

আর আমি পান করে নিলাম বিষের গেলাস!


একটা দৃশ্য বদলে দিতে পারে এইসব আখ্যান

একটা চাহনি পালটে দিতে পারে চলার গতি

আর আমিও পেরিয়ে যেতে পারি লোকালয়

ফেলে আসতে পারি সকল সম্ভাবনা।


তোমার উপস্থিতিই কেবল খুলে দিতে পারে সকল সম্ভাবনার দ্বার, পূর্ণ করতে পারে সকল আয়োজন।

এক জন্ম । তারাপদ রায়

 

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

ভালো বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো । ত্রিদিব দস্তিদার

 

ভালোবেসে কি ফতুর করা যায় ?

ভালোবাসা ফতুর হয় না কখনো

তবে আমি তোমাকে ভালো বাসতে বাসতে

ফতুর করে দেবো

তোমার ভালোবাসা এক সময় ফুরিয়ে যাবে

আমার ভালোবাসার আজন্ম উত্তাপে

বাষ্পায়িত হবে তোমার ভালোবাসা

আমার ভালোবাসার গতি ও তীব্রতায়

ম্রিয়মান হবে

জলে, অন্তরীক্ষে

ভালোবাসা-স্থলের অতি ব্যবহারে,

হবে তুমি প্রাচীন কোন নৃতত্বের সন্ধান

নতুন প্রেমিকের কাছে

ভালো বাসতে বাসতে তোমাকে

ফতুর করে দেবো

ফতুর করে করে দেবো

ভালো বাসতে বাসতে বাসতে…

আমরা নিখুঁত নই । রণজিৎ দাশ

 আমরা নিখুঁত নই। একটা ঘাসফড়িং নিখুঁত, একটা সন্ধ্যাতারা নিখুঁত, একটা বৃষ্টির ফোঁটা নিখুঁত। নিখুঁত একটা বসন্তের রাত। কিন্তু আমরা জন্ম থেকেই পঙ্গু, বেঢপ, মূর্খ এবং দিশাহারা। আমরা ধূর্ত, জালিয়াত, ভঙ্গুর, ভিখারি। আমরা জন্মাই শুধু ভুল স্বপ্নে ভুল কামে ভুল শহরে হেঁটে নিজেদের ধ্বংস করার জন্য, ভুল মানুষকে ভালোবেসে এবং আঘাত পেয়ে, বুক ভেঙে মরে যাওয়ার জন্য। শুধু, সবশেষে টের পাই, আমাদের ভুলগুলি কি মারাত্মক নিখুঁত!

নাকাড়া বাজছে । কবিতা সিংহ

 

নাকাড়া বাজছে, পাহাড় বাজছে,

নাকাড়া বাজছে, আঁধার বাজছে বনের ভিতরে


নাকাড়া, নাকাড়া, নাকড়া, নাকাড়া

মনে হয় যেন বুক ফেটে যায়

বুক ফেটে যায় বুকের চামড়া !


কিসের কাঁদন? দুরু দুরু দুরু-

বুকের ভিতর সঘন কাঁপন

চমকায় ধ্বনি, ধ্বনি প্রতিধ্বনি

ফেরায় পাহাড়-পাহাড়ের বুক

বুক থেকে বুকে ছড়ায় আওয়াজ

নাকাড়ার বুকে ধরে রাখা বাজ

বাজের শব্দ, শব্দ ভাঙছে, প্রবল ছন্দে


মানুষ শুনছে, মানুষ বুঝছে

ভরে-আনন্দে ! ভয়ে আনন্দে!

নাকাড়া বাজছে, পাহাড় বাজছে

বনের ভিতর বৃক্ষে বৃক্ষে তালে তালে তালি

রাত্রি বাজছে দিবস বাজছে

ওপরে আকাশ, ছড়ানাে নাকাড়া

নাকাড়ার বুকে ছাওয়া আছে নীল


মহাকরােটির মােহন চামড়া

চাঁদ মাঝখানে ক্ষুদ্র চাকতি

যেখানে হাড়ের তাসের আঘাতে

বুকে ঢেউ উঠে জোয়ার জাগছে

নাকাড়া বাজছে পাহাড় বাজছে

ঝম ঝম ঝম লাখাে করতালি

পাতায় পাতায় জ্যোছনা ঢালছে

ধ্বনির রূপালি ভয়াল আওয়াজ

আকাশে যে ঘােরে সেই একা বাজ

নাকাড়া ফাটায় নাকাড়া ফাটায়

পাহাড়ে এখন সুরের স্বরজি।

হামাগুড়ি । শঙ্খ ঘোষ

 

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল হঠাৎ।

বাইরে কি ঝড় হচ্ছে?

দাপাদাপি করছে জানলার পাল্লাদুটো,

মাঝে মাঝে বিজলি ঝলকাচ্ছে।

ফের শুয়ে পড়তে গিয়ে সেই বিদ্যুতের ছটফটে আলোয় মনে হল ঘরের মধ্যে যেন হামা দিচ্ছে কেউ।

-'কে ওখানে? কে?'

হামা কোনো শব্দই করে না।

উঠে আসি কাছে, আবারও জিজ্ঞেস করিঃ

-'কে আপনি? কী চান?'

সে তবু নিশ্চুপ থেকে এ - কোণে ও -কোণে ঘুরছে

মাথা তুলছে না কিছুতেই, চোখে চোখ নয়।

-'কিছু কি খুঁজছেন আপনি?'

শুনতে পাচ্ছিঃ

-'খুঁজছি ঠিকই, খুঁজতে তো হবেই -

পেলেই বেরিয়ে যাব, নিজে নিজে হেঁটে।'

-'কি খুঁজছেন?'

মিহি স্বরে বললেন তিনি :

-'মেরুদণ্ডখানা।'

সেই মুহুর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের। চমকে উঠে দেখিঃ

একা নয়, বহু বহু জন

একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ-কোণে ও কোণে

 ঘর জুড়ে।

_