দ্বিচারিনী । ইমরোজ সোহেল
দরজা খুললেই একচিলতে উঠোন
এর পর তোমার আঁটোসাটো ঘর
খিল এঁটে বসে আছো এক'শ ছিষট্টি বছর
তিন পা হাঁটলেই যেতে পারি
টোকা দিতে পারি বন্ধ দরজায়
কিন্তু যাইনি,
চোখে অন্ধকার ওঁৎ পেতে আছে
লাঠি নেই, যাদুর কাঠিও নেই
কেমন করে যাবো?
কেমন করে তোমার অস্তিত্ব ছোবো?
যেদিন বেদখল হয়ে গেলে তুমি
তোমার জমিনে ঢুকে পড়লো অন্যরকম পর
বিজ্ঞ চাষীর মতো শুরু করলো চাষাবাদ
সেদিন থেকেই আমি চোখ বুঁজে আছি
চোখ বুঁজে বাতাসের যাওয়া আসা দেখি
মেঘ দেখি, বৃষ্টি দেখি
ভিখিরির চোখের মতো নিরঙ্কুশ চাতুরি দেখি
নষ্ট মেয়ের আগুনের ভ্রষ্ট হল্কা দেখি...
এই সব প্রতিবিম্ব প্রত্যহ প্রতিদিন দেখি
শুধু তোমাকে দেখিনা।
খিল এঁটে বসে আছো এক'শ ছিষট্টি বছর
ঢুকতে পারি না আমি সেই ঘরে
আমি জানি,
তোমার পায়ে ঢেউএর মতো অবিরত
আছড়ে পড়লেও
ওই মরচে পড়া খিল তুমি খুলবে না কোনদিন
তাই আর দিই না টোকা ওই বন্ধ দরজায়
পা নিসপিস করে, তবু এক লাফে তিন পা হাঁটি না।
মনে হয় অন্য কোন দরজা আছে অই ঘরে
দরজার সেই খিল দিগম্বরের মতো
হাট করে খোলা
সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পরে পর ও ঘরহীন অনেক
পুরুষ...
ওম দেয় তোমার শরীরে
জবুথবু বিছানার মতো কুঁকড়ে যাও তুমি
কিন্তু কিচ্ছু বলো না
ঘুণে ধরা এই নেশা দিশেহারা কাকের মতো
বৃষ্টিহীন কার্নিশ খোঁজে
পায় না কিছুই,
অবশেষে উড়ে উড়ে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো
ক্লান্ত হয়ে যাও....সমুদ্রে হারাও।
দরজা খুললেই এক চিলতে উঠোন
এরপর তোমার আঁটোসাটো ঘর
খিল এঁটে বসে আছো এক'শ ছিষট্টি বছর
তিন পা হাঁটলেই যেতে পারি
কিন্তু যাইনি কখনো
অন্য দরজার খিল দিগম্বরের মতো
হাট করে খোলা
এত যে সংসার হলো, লেনাদেনা হলো,
এই সত্য কথাটি বলোনি কোনদিন কোন অবসরে।
একটি অন্ধকার ঘরের দুইটি দরজা থাকে
লোভ ও হিংসারও দুইটি দরজা
কাম ও ক্রোধেরও দুইটি
এই সব রিপুর মতো তোমারো দুইটি দরজা
একটির খিল এঁটে অন্যটি খুলে রাখো তুমি
আমার অনুভব থেকে এই সত্য ভূমিষ্ট হতে
লেগে গেলো এক'শ ছিষট্টি বছর।
দুই হাত দুই পা দুইটি চোখের মতো
হৃদয়টাকে দুইভাগ করে ছলে বলে একে ওকে দেবে
আগে তো বলো নি...
অথচ কেটে গেলো এক'শ ছিষট্টি বছর কত সহজেই।
তুমি যেখানেই যাও । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি।
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি গেলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ
দিয়ে কে সরিয়েছে চুর্ণ অলক?
তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনী
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার
চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না।
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয় সে এসেছে,
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি-
এলাচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো!
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি-
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি।
হেসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!
জানাজানি । আসাদ চৌধুরী
বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
পাখির ভাষার মান দিতে যে
বাঙালি দেয় জান-
পাখি যে তা জানে,
তাইতে পাখি পাগল করে,
বিহান বেলার গানে।
বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
উদার আকাশ যে – ইশারায়
ডাক দিয়ে যায় প্রাণে,
বাঙালি তা জানে।
তাইতো আকাশ টিপ দিয়ে যায়,
ললাটের মাঝখানে।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি । শঙ্খ ঘোষ
আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে !
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি ?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমন ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে ।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
মায়ের বলিরেখা । সুজন দেবনাথ
একটি মেয়ে যুদ্ধ করছেন সূর্যের সাথে, অল্প বয়স থেকে
সূর্যের সাথে কেউ জিততে পারে না, তিনিও পারেন নি।
তিনি জানতেন, হারবেন – তবু পথ ছাড়েন নি।
আমি সেই পথে পৃথিবীর সাথে পঁচিশটি সূর্য পার হয়ে
দেখি – তার মুখে অনেক যুদ্ধ-চিহ্ন, অনেক বলিরেখা।
মেয়েটি সূর্যের সাথে যুদ্ধ করেছেন, খুব অল্প বয়স থেকে
এই যোদ্ধা মেয়েটিকে আমি মা নামে ডাকি, জন্ম থেকে।
মায়ের মুখের বলিরেখা আমার ভালো লাগে না, আমি আমার
শৈশবের মাকে চাই। মাঝে মাঝে শৈশব ছুঁতে খুব ইচ্ছে করে,
আমি মায়ের বলিরেখায় হাত বুলাই, বলিরেখায় আমার শৈশব
খুঁজে পেলেও, আমার শৈশবের মা নাই। মায়ের বলিরেখা
আমার ভালো লাগে না, একদিন সূর্যকে বিশ্রী গালাগালি দেই।
সূর্য বলে, আমি নই, ওই সব বলিরেখা আসলে বানিয়েছিস তুই।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না, মায়ের পেটের দিকে
তাকাতে পারি না – অপরাধী, চির-অপরাধী হয়ে রই।
মায়ের কোলে মাথা রাখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু
তার মুখের প্রতিটি বলিরেখা আমাকে আসামী করে দেয়,
মায়ের পেটের প্রতিটি দাগ আমাকে ফাঁসির রায় শুনায়।
ছোটবেলার বাবা । সুজন দেবনাথ
আমার ছোটবেলার বাবা সব জানতেন
সবকিছুতে সঠিক ছিলেন
একদিন বাবা পড়ালেন, অসৎসঙ্গ ত্যাগ করো–
আমি আর টিটোর সাথে খেলিনি
কারণ বাবা জেনে যাবেন, বাবা সব জানতেন
সেই বাবা হঠাৎ আমার চেয়ে কম জানতে শুরু করলেন
একদিন বাবা বললেন, মিথ্যা খুব খারাপ, কখনো মিথ্যা বলবি না
আমি বুঝলাম, বাবা অতো বেশি জানেন না
ততোদিনে জেনে গিয়েছিলাম, ভিখারী পয়সা চাইলে
টাকা থাকলেও ‘নেই’ বলা যায়, ওরকম মিথ্যায় কিছু হয় না
বাবা সেই যে কম জানতে শুরু করলেন
কম জানতে জানতে, একেবারে বোকাই হয়ে গেলেন
বাবা বলতেন –
রবিঠাকুরের ফটো নিয়ে সাঁতরে উত্তর পুকুর পার হতে পারলে
আমি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাব
এ কথা এখন আর বিশ্বাস করি না
যতোদিন বিশ্বাস করতাম, ততোদিনই বড় হতে চাইতাম।
রবীন্দ্রনাথ হতে চাইতাম
বাবা – তুমি কম জানতে শুরু করলে কেন?
আমি যে আবার বড় হতে চাই
বড় হবার জন্য
সেই সবজান্তা বাবাকেই চাই
যে বাবার ছেলে, বুক উঁচু করে বলে –
মিথ্যা বলা সত্যিই মহাপাপ
কারণ আমার বাবা বলেছেন, আমার বাবা সব জানেন
কথায় কথায় । তারাপদ রায়
ছবির মতো আকাশ,
আর আকাশের নিচে সেই বোকা মানুষ
যার কথায় কথায় চোখে জল আসে।
আর যখন চোখে জল নেই,
তখন চোখের মণিতে
এক ছায়াভরা বুড়ো আম গাছের নীচে
বিরাট দুপুর, আটচালা ঘরের বারান্দায়
মানুষজন রং-বেরং বিড়ালের ছানা
উঠোন থেকে খড়ের টুকরো মুখে করে
ছুটে পালাচ্ছে ছাই ছাই ধানি ইঁদুর ।
এ ছবির কোথাও সে নেই।
তবুও আটচালা ঘর, রঙিন বিড়াল
আর ধানি ইঁদুরের ত্রস্ত চলা ফেরা
সারা দুপুর বারান্দায় কারা সুপুরি কাটছে
ধান থেকে চাল কুটো বাছছে তো বাছছেই।
কথায় কথায় তার চোখে জল আসে।
কবিতার কসম খেলাম । হেলাল হাফিজ
আমি আর আহত হবো না,
কোনো কিছুতেই আমি শুধু আর আহত হবো না।
যে নদী জলের ভারে হারাতো প্লাবনে
এখন শ্রাবণে সেই জলের নদীর বুকে
জলাভাবে হাহাকার দেখে আমি আহত হবো না।
সবুজ সবুজ মাঠ চিরে চিরে
কৃষকের রাখালের পায়ে গড়া দু’পায়া পথের বুকে
আজ সেই সরল সুন্দর সব মানুষের চিতা দেখে
আহত হবো না, আর শুধু আহত হবো না।
বৃক্ষ হারালে তার সবুজ পিরান, মৃত্তিকার ফুরালে সুঘ্রাণ,
কষ্টের ইস্কুল হলে পুষ্পিত বাগান, আমি আহত হবো না।
পাখি যদি না দেয় উড়াল, না পোড়ে আগুন,
অদ্ভুত বন্ধ্যা হলে উর্বরা ফাগুন, আমি আহত হবো না।
মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ
আমি আহত হবো না, আহত হবো না।
কবিতার কসম খেলাম আমি শোধ নেবো সুদে ও আসলে,
এবার নিহত হবো
ওসবের কোনো কিছুতেই তবু শুধু আর আহত হবো না।
মৌলিক নিষাদ । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটিও তারা আজ।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।
এই এক আশ্চর্য সময়।
যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
যখন পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
পিতামহ, আমি এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন আকাশে আলো নেই,
যখন মাটিতে আলো নেই,
যখন সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ–ভয়।
পিতামহ, তোমার আকাশ
নীল–কতখানি নীল ছিল?
আমার আকাশ নীল নয়।
পিতামহ, তোমার হৃদয়
নীল–কতখানি নীল ছিল?
আমার হৃদয় নীল নয়।
আকাশের, হৃদয়ের যাবতীয় বিখ্যাত নীলিমা
আপাতত কোনো-এক স্থির অন্ধকারে শুয়ে আছে।
পিতামহ, আমি সেই ভয়ের দরুণ অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি! পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখেছি, রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটাও তারা আজ।
মনে হয়, আমি এক অমোঘ মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার
অন্ধকারে জেগে আছে মৌলিক নিষাদ–এই ভয়